বাপের রক্ত আছে গায়ে

"বাপের রক্ত আছে গায়ে"—একটি পুরুষতান্ত্রিক প্রবাদ ও বিজ্ঞানের মুখোমুখি সমাজ

রুবাইয়া বিধু

"বাপের রক্ত আছে না গায়ে?"—বাঙালি সমাজে বহুল ব্যবহৃত এক প্রবচন। সন্তানের সাহস, স্বভাব, কিংবা সাফল্য দেখলেই আত্মীয়-পরিজনের মুখে শোনা যায় এই কথাটি। উদ্দেশ্য সাধারণত প্রশংসা, কিন্তু এর গভীরে রয়েছে এককেন্দ্রিক চিন্তাধারা, যেখানে সন্তানের গঠন ও গুণাবলির কৃতিত্ব কেবল পিতার রক্তকেই দেওয়া হয়। প্রশ্ন হলো—এই কথাটির পেছনে কি আদৌ বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে? না কি এটি কেবল আমাদের সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ?


# জীববিজ্ঞানের চোখে সন্তানের গঠন:

একজন মানুষের জন্মে বাবা ও মায়ের সমান অবদান রয়েছে—এটি একটি প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক সত্য। মানবদেহে ৪৬টি ক্রোমোজোম থাকে, যার অর্ধেক (২৩টি) সন্তানের পিতা থেকে আসে, আর বাকি অর্ধেক মাতা থেকে। এই ক্রোমোজোমে থাকে সন্তানের শারীরিক বৈশিষ্ট্য, ব্যক্তিত্বের প্রবণতা, এমনকি কিছু মানসিক স্বভাবও।

এছাড়াও মায়ের গর্ভে সন্তানের বিকাশ ঘটে একটানা ৯-১০ মাস ধরে। এই সময় মায়ের শরীর, মন এবং জীবনের ওপর যে চাপ পড়ে, তা পিতার অবদান ছাড়িয়ে যায় বহু দূর। তবুও সমাজে সন্তান গঠনের এই পরিশ্রমী অবদান প্রায় উপেক্ষিত।


"বাপের রক্ত" কথাটির প্রতীকী ব্যবহার:

এই প্রবাদের মূলে রয়েছে সমাজে পিতার নাম, বংশ ও পরিচয়ের গুরুত্ব। সন্তান কৃতী হলে বলা হয়—"বাপের রক্ত বইছেই!" আবার ব্যর্থ হলে মা-কে ঠেলে দেওয়া হয় অভিযোগের কাঠগড়ায়। এটি এক ধরনের প্রতীকী চিন্তাচর্চা, যেখানে উত্তরাধিকার, গুণ, কিংবা স্বভাব—সব কিছুর উৎস মনে করা হয় কেবল পুরুষ।

কিন্তু, বাস্তবে মানুষের গুণাবলি আসে জিনের পাশাপাশি পরিবেশ, অভিজ্ঞতা, শিক্ষা ও লালন-পালনের মধ্য দিয়ে। ফলে একে শুধুই “রক্ত” দিয়ে ব্যাখ্যা করাটা সংকীর্ণ।

# পিতৃতন্ত্রের শেকড়ে গাঁথা সমাজ:

এই ধরনের প্রবাদ সমাজের পিতৃতান্ত্রিক চেতনার প্রতিফলন। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায়, উত্তরাধিকার, জমিজমা, পরিচয়—সবকিছুতেই পুরুষকেই প্রধান ধরা হয়েছে। সন্তানের গুণ পিতার মুখ উজ্জ্বল করে, আর দোষ হলে মায়ের শিক্ষা-দীক্ষার খামতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

এই ব্যবস্থায় মা একজন গর্ভধারিণী হলেও, সমাজে তার মর্যাদা হয় অনেকটা নেপথ্য শিল্পীর মতো—উপস্থিত, কিন্তু অদৃশ্য।

# নতুন চিন্তা গড়ে তোলা জরুরি

একটি সমাজ কতটা প্রগতিশীল, তা বোঝা যায় সে সমাজ নারীর অবদানকে কতটা মূল্যায়ন করে তা দেখে। "বাপের রক্ত" জাতীয় প্রবাদগুলো সমাজে একরকম পুরুষকেন্দ্রিক শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা গড়ে তোলে। কিন্তু এখন সময় এসেছে এসব ভাবনাকে প্রশ্ন করার, আর এক নতুন ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেওয়ার।

সন্তান একজন পূর্ণ মানুষ—তার রক্তে, চিন্তায়, আচরণে আছে মা-বাবার সম্মিলিত প্রতিফলন। তাই যদি কোনো সন্তানের গুণ প্রশংসার যোগ্য হয়, তবে তা মা-বাবা উভয়ের গৌরব। আর ব্যর্থতা? সেটি কেবল কারও “রক্ত” নয়, বরং সামাজিক, শিক্ষাগত এবং নৈতিক কাঠামোরই প্রতিফলন।

লেখক: কলামিস্ট

পাঠকের মন্তব্য