৯২ শতাংশই ঋণ খেলাপি, অবসায়নের পথে পদ্মা ব্যাংক

টপাট ও অনিয়মের কারণে ধসে পড়া ব্যাংকগুলোর তালিকায় থাকা ব্যাংকের মধ্যে একটি পদ্মা ব্যাংক। একসময় সরকারি সহায়তায় টিকে থাকা এই ব্যাংকের এখন প্রায় সব আর্থিক সূচকই ঋণাত্মক। ঋণের ৯২ শতাংশ খেলাপি, মূলধন ঘাটতি ছাড়িয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা, আর ৬০টির মধ্যে ৫৯টি শাখাই লোকসান গুনছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অফ-সাইট সুপারভিশন ব্যাংকটিকে একীভূত বা অবসায়নের সুপারিশ করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে স্বল্প সময়ের মধ্যে তা ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো সম্ভাবনাই নেই। তাই ব্যাংক রেজুলেশন ডিপার্টমেন্টকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। পাশাপাশি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে সব আর্থিক সূচকে উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

 পদ্মা ব্যাংকের গল্প শুরু থেকেই বিতর্কিত। অনুমোদন পাওয়ার আগেই অফিস খোলা ও কর্মী নিয়োগের মতো অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে ব্যাংকটি। পরে রাজনৈতিক সম্পর্কের জোরে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত টেনে নেয় উদ্যোক্তারা। কিন্তু সেই আমানতই পরিণত হয় দুর্নীতির উৎসে। চার বছরের মধ্যেই ব্যাংকটি সংকটে পড়ে এবং ২০১৭ সালে তৎকালীন চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর পদত্যাগে বাধ্য হন।

 ব্যাংকটিকে বাঁচাতে সরকারি চার ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) মূলধন সহায়তা দেয়। এরপর চেয়ারম্যান হন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। কিন্তু গ্রাহকের আস্থা আর ফেরেনি। নানা প্রণোদনা ও ছাড়ের পরও ব্যাংকটি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের শুরুতে সরাফাতও পদ্মা ব্যাংক ছাড়েন।

চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকের আমানত দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় অপরিবর্তিত। এর বিপরীতে ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকায়, যার মধ্যে ৫ হাজার ১৩১ কোটি টাকাই খেলাপি। অর্থাৎ বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৯২ শতাংশই অপ্রাপ্তিযোগ্য।

ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি এখন ৫ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত (সিআরএআর) নেমে এসেছে ঋণাত্মক ১৫০ দশমিক ২৭ শতাংশে, যেখানে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বেসেল-৩ অনুযায়ী তা হওয়া উচিত ন্যূনতম ১২ দশমিক ৫ শতাংশ।

 তথ্য বলছে, ব্যাংকটির সুদ আয় দিয়ে আর আমানতের সুদ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। ২০২৪ সালে সুদ থেকে আয় হয়েছে মাত্র ৫০ কোটি টাকা, কিন্তু সুদ বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৬৭৪ কোটি টাকা। নিট সুদ আয় ঋণাত্মক হয়েছে ৬২৬ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত বছর ব্যাংকের লোকসান দাঁড়িয়েছে ৯৬৭ কোটি টাকায়। এ বছরের প্রথম ছয় মাসেও লোকসান ৫০৩ কোটি টাকার বেশি।

তারল্য পরিস্থিতিও ভয়াবহ। ব্যাংকটির বিধিবদ্ধ নগদ জমা (সিআরআর) ঘাটতি ১৭৩ কোটি টাকা, আর সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদ (এসএলআর) ঘাটতি ২১৩ কোটি টাকা।

সব মিলিয়ে ব্যাংকটি এখন কার্যত টিকে থাকার লড়াইয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলে পদ্মা ব্যাংককে একীভূত বা অবসায়নের পথেই হাঁটতে হবে।

পাঠকের মন্তব্য